হার্টের সমস্যার লক্ষণ গুলো কি কি এবং দুর্বল হার্ট চেনার উপায়?

হার্টের সমস্যার লক্ষণ গুলো কি কি

প্রতিদিন আমাদের হার্ট প্রায় এক লাখ বার স্পন্দিত হয় এবং দেহের প্রতিটি কোণায় অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত পৌঁছে দেয়। কিন্তু যদি এই কাজে বিঘ্ন ঘটে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্যানুসারে, প্রতিবছর প্রায় ১.৮ কোটি মানুষ হৃদরোগজনিত কারণে মারা যায়, যা বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রধান কারণ। অনেকেই হৃদরোগের লক্ষণগুলো চেনার আগেই বড় কোনো বিপদের শিকার হন। তাই হার্টের সমস্যার লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন হওয়া জীবন বাঁচানোর মতোই গুরুত্বপূর্ণ।

হার্ট অ্যাটাক হঠাৎ করেই ঘটে না; শরীর আগেই সংকেত পাঠায়। অথচ, গবেষণায় দেখা গেছে, ৫০% মানুষ হার্ট অ্যাটাকের আগের লক্ষণগুলোকে অবহেলা করেন। বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, অতিরিক্ত ক্লান্তি বা অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন- এগুলো হয়তো আপনার হার্টের কিছু নীরব সতর্কবার্তা! আজকের এই আর্টিকেলে আমরা হার্টের সমস্যার লক্ষণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, যাতে আপনি নিজের এবং প্রিয়জনের সুস্বাস্থ্যের প্রতি আরও যত্নবান হতে পারেন। তবে চলুন শুরু করা যাক। 

হার্টের সমস্যার লক্ষণ আগে থেকে জানা কেন জরুরি?

হার্টের সমস্যা বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি হঠাৎ করে গুরুতর আকার ধারণ করে। তবে এই সমস্যা সাধারণত ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এবং এর প্রাথমিক লক্ষণগুলো আগে থেকেই জানা থাকলে অনেক জটিলতা এড়ানো সম্ভব হয়। অনেক মানুষ মনে করেন, হার্টের অসুস্থতা কেবলমাত্র তীব্র বুকের ব্যথার মাধ্যমে প্রকাশ পায়, কিন্তু বাস্তবে শ্বাসকষ্ট, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, অতিরিক্ত ক্লান্তি, মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব বা বুকে সামান্য চাপ অনুভব করাও হার্টের সমস্যার পূর্বাভাস হতে পারে। এসব লক্ষণ আগে থেকে জানা থাকলে মানুষ দ্রুত সচেতন হতে পারে এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারে, যা জীবন বাঁচাতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে, হার্ট অ্যাটাকের আগেও শরীর ছোট ছোট সংকেত দেয়, যেমন হাঁটলে সহজেই হাঁপিয়ে যাওয়া, বাম কাঁধ বা চোয়ালে অস্বাভাবিক ব্যথা অনুভব করা, যা হার্টের কার্যক্ষমতার অবনতি নির্দেশ করে। এই লক্ষণগুলো অবহেলা করলে অবশেষে মারাত্মক হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের ঝুঁকি বাড়তে পারে।

হার্টের সমস্যার লক্ষণ আগে থেকে জানা থাকলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয় এবং চিকিৎসা শুরু করাও সম্ভব হয়, যা মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যদি কেউ প্রথম পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল বা অনিয়ন্ত্রিত রক্তচিনি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে হৃদরোগের জটিলতা অনেকাংশে হ্রাস পায়। যারা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন এবং হার্টের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকেন, তারা সাধারণত দ্রুত জীবনধারার পরিবর্তন আনতে সক্ষম হন, যেমন স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং ধূমপান বা অ্যালকোহল পরিহার করা। অনেক ক্ষেত্রে, পুরুষ ও নারীদের হৃদরোগের লক্ষণ ভিন্ন হতে পারে—পুরুষদের ক্ষেত্রে সাধারণত বুকের তীব্র ব্যথা দেখা দেয়, কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে ক্লান্তি, বমি ভাব বা পিঠে ব্যথার মতো লক্ষণ দেখা যেতে পারে। এসব তথ্য আগে থেকে জানা থাকলে, ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সময় নষ্ট না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া সম্ভব হয়, যা জীবন রক্ষাকারী হতে পারে।

হার্টের সমস্যার লক্ষণ গুলো কি কি

হার্টের সমস্যার লক্ষণ গুলো কী কী?

বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি

হার্টের সমস্যার অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি। এই ব্যথা সাধারণত মাঝখানে অনুভূত হয় এবং তা ভারী চাপ বা জ্বালাপোড়া ধরনের হতে পারে। অনেক সময় এটি বুকের বাম দিকে বেশি অনুভূত হয়, যা হার্ট অ্যাটাকের সতর্ক সংকেত হতে পারে। এই ব্যথা কয়েক মিনিট স্থায়ী হতে পারে এবং মাঝে মাঝে কমে গেলেও আবার ফিরে আসে। বিশেষ করে শারীরিক পরিশ্রমের সময় বা মানসিক চাপের কারণে এটি তীব্র হতে পারে। অনেকে এটিকে সাধারণ গ্যাসের ব্যথা বা বুকজ্বালার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন, যা মারাত্মক ভুল হতে পারে।

বুকে অস্বস্তির আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি কখনো কখনো অন্যান্য অঙ্গেও ছড়িয়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ব্যথাটি পিঠ, ঘাড়, কাঁধ বা চোয়ালে অনুভূত হতে পারে, বিশেষ করে যদি এটি হার্টের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়। মহিলাদের ক্ষেত্রে, অনেক সময় বুকের ব্যথার পরিবর্তে বুকের ভারী লাগা বা চেপে ধরা অনুভূতি হয়। এটি উপেক্ষা করা উচিত নয়, কারণ এমন লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

শ্বাসকষ্ট

শ্বাসকষ্ট হার্টের সমস্যার আরেকটি গুরুতর লক্ষণ, যা সাধারণত হার্ট ফেইলিউর বা হার্ট অ্যাটাকের পূর্বাভাস হতে পারে। যখন হার্ট রক্ত পাম্প করতে ব্যর্থ হয়, তখন শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়, যার ফলে শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়। এটি মূলত হাঁটাচলা, শারীরিক পরিশ্রম বা এমনকি বিশ্রামের সময়ও দেখা দিতে পারে। যাদের দীর্ঘমেয়াদি হৃদরোগ আছে, তারা শোবার সময় শ্বাসকষ্ট অনুভব করতে পারেন, বিশেষ করে যদি তারা একেবারে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকেন। এ কারণে, অনেকে রাতে ঘুমানোর জন্য অতিরিক্ত বালিশ ব্যবহার করেন বা বসে ঘুমানোর চেষ্টা করেন।

শ্বাসকষ্টের আরও একটি দিক হলো এটি অন্য কিছু লক্ষণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আসতে পারে, যেমন বুকে ব্যথা, ক্লান্তি বা পায়ের ফোলা। অনেক সময় ফুসফুসে অতিরিক্ত তরল জমার কারণে এটি ঘটে, যা হার্ট ফেইলিউরের অন্যতম লক্ষণ। যদি কোনো ব্যক্তি সামান্য কাজ করলেও দমবন্ধ লাগার অনুভূতি পান, তবে তা উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত, কারণ এটি একটি আসন্ন হৃদরোগের সংকেত হতে পারে।

হাত, পিঠ, ঘাড় বা চোয়ালে ব্যথা

অনেকেই মনে করেন, হার্টের সমস্যা মানেই শুধুমাত্র বুকে ব্যথা অনুভব করা। কিন্তু বাস্তবে, এই ব্যথা শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে যেতে পারে, বিশেষ করে পিঠ, ঘাড়, চোয়াল এবং বাম হাতে। বাম হাতে ব্যথা ছড়িয়ে পড়া হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম প্রধান লক্ষণ। এটি সাধারণত প্রথমে হালকা ব্যথা হিসেবে অনুভূত হতে পারে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তীব্র হয়ে ওঠে। কখনো কখনো এই ব্যথা ব্যায়াম বা পরিশ্রমের পর বেড়ে যায় এবং বিশ্রাম নিলে কমে যায়, যা এনজাইনা (Angina) নামক হার্টের সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে।

এই ধরনের ব্যথা কখনো কখনো অন্যান্য কারণেও হতে পারে, যেমন পেশির টান বা হাড়ের সমস্যা। তবে, যদি এটি হঠাৎ করে শুরু হয় এবং বিশেষ করে বুকে ব্যথার সঙ্গে থাকে, তাহলে তা মারাত্মক হতে পারে। বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে, হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ হিসেবে এই ধরনের ব্যথা বেশি দেখা যায়। তাই, যদি কোনো ব্যক্তি পিঠ, ঘাড় বা হাতে ব্যথা অনুভব করেন এবং তা স্বাভাবিকের তুলনায় ভিন্ন বা নতুন মনে হয়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

অস্বাভাবিক ক্লান্তি

অস্বাভাবিক ক্লান্তি বা অবসাদ হৃদরোগের একটি গোপন লক্ষণ হতে পারে, যা অনেকেই গুরুত্ব দেন না। স্বাভাবিক শারীরিক পরিশ্রমের পর ক্লান্ত হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু যদি কেউ স্বাভাবিক কাজকর্মের পরেও অতিরিক্ত দুর্বলতা অনুভব করেন, তাহলে এটি হার্টের সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে, হার্টের অসুস্থতার অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো দীর্ঘমেয়াদি ক্লান্তি অনুভব করা। অনেকে দেখবেন, আগের তুলনায় সামান্য কাজ করলেও শরীরে শক্তির অভাব দেখা দিচ্ছে, যা সাধারণ ক্লান্তির চেয়ে অনেক বেশি মারাত্মক হতে পারে।

হার্ট যখন ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, তখন শরীরের বিভিন্ন অংশে পর্যাপ্ত রক্ত ও অক্সিজেন পৌঁছায় না, যার ফলে দুর্বলতা দেখা দেয়। এটি বিশেষত সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময় অথবা সারাদিনের কাজের পর তীব্রভাবে অনুভূত হতে পারে। ক্লান্তির সঙ্গে যদি শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড় করা বা মাথা ঘোরা দেখা দেয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। অনেক সময় এটি হার্ট ব্লক বা হার্ট ফেইলিউরের পূর্বাভাস হতে পারে, যা অবহেলা করলে মারাত্মক হতে পারে।

ঘাম হওয়া

অতিরিক্ত বা ঠান্ডা ঘাম হওয়া হার্টের সমস্যার একটি অস্বাভাবিক লক্ষণ, যা অনেকেই বুঝতে পারেন না। স্বাভাবিক অবস্থায় গরম আবহাওয়া বা পরিশ্রম করলে ঘাম হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু যদি কোনো ব্যক্তি শীতল পরিবেশে বা বিশ্রামের সময় হঠাৎ প্রচণ্ড ঘামতে শুরু করেন, তবে এটি হৃদরোগের সংকেত হতে পারে। বিশেষ করে, যদি এই ঘামের সঙ্গে বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট বা মাথা ঘোরা দেখা দেয়, তাহলে এটি হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ হতে পারে।

ঠান্ডা ঘামের মূল কারণ হলো হার্ট যখন ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, তখন শরীর এটি সামলানোর জন্য স্নায়ু ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেখায়। এর ফলে, শরীর স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ঘামতে শুরু করে। এটি পুরুষ এবং মহিলাদের উভয়ের ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে। মহিলাদের ক্ষেত্রে এটি অনেক সময় মেনোপজের লক্ষণের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা হয়, যা বিপজ্জনক হতে পারে। তাই, অপ্রত্যাশিত ঘাম হলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

বুক ধড়ফড় করা

হার্টবিট অনিয়মিত হওয়া বা বুক ধড়ফড় করা (Palpitations) অনেক সময় স্বাভাবিক বিষয় মনে হলেও, এটি হার্টের সমস্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হতে পারে। যখন হৃদস্পন্দন স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত হয়ে যায় (Tachycardia) বা অত্যন্ত ধীর হয়ে যায় (Bradycardia), তখন এটি হৃদরোগের ইঙ্গিত দিতে পারে। বুক ধড়ফড় করার অনুভূতি কখনো কখনো একবারেই স্বাভাবিক হতে পারে, বিশেষ করে অতিরিক্ত ক্যাফেইন সেবন, দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপে। তবে, যদি এটি নিয়মিতভাবে ঘটে এবং দীর্ঘ সময় ধরে থাকে, তাহলে এটি হার্টের অনিয়মিত ছন্দ (Arrhythmia) বা অন্য কোনো কার্ডিওভাসকুলার সমস্যার সংকেত হতে পারে।

অনিয়মিত হৃদস্পন্দন অনেক সময় অক্সিজেনের ঘাটতি বা হৃদযন্ত্রের সংকোচন-প্রসারণে বাধা সৃষ্টি করে। এটি হার্ট ব্লক, কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Cardiomyopathy), বা হার্ট ফেইলিউরের একটি লক্ষণ হতে পারে। বুক ধড়ফড় করার সঙ্গে যদি শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, বুকে ব্যথা বা ক্লান্তি দেখা দেয়, তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। অনেক সময় ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা, থাইরয়েডের সমস্যা, বা উচ্চ রক্তচাপের কারণেও বুক ধড়ফড় করতে পারে, তাই সঠিক কারণ নির্ণয় করা জরুরি।

বমি বমি ভাব বা হজমের সমস্যা

হার্টের সমস্যার একটি কম প্রচলিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হলো বমি বমি ভাব বা হজমের সমস্যা। অনেকে মনে করেন যে, বুক ব্যথা বা শ্বাসকষ্টই একমাত্র হৃদরোগের লক্ষণ, কিন্তু বাস্তবে, অনেক রোগী হার্ট অ্যাটাকের আগে বা পরে পেটে অস্বস্তি, গ্যাস্ট্রিকের মতো অনুভূতি বা বমি বমি ভাব অনুভব করেন। এটি মূলত রক্ত সঞ্চালনে বাধার কারণে হতে পারে, যা পরিপাকতন্ত্রের কাজকে ব্যাহত করে। বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে, বমি আসা বা পেটে চাপ লাগা অনেক সময় হার্ট অ্যাটাকের প্রধান লক্ষণ হতে পারে।

হার্টের রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হলে পেটের মধ্যে চাপ অনুভূত হয়, যা অনেক সময় গ্যাস্ট্রিক বা এসিডিটির ভুল ধারণা তৈরি করে। অনেকেই এ কারণে ব্যথার প্রকৃত কারণ না বুঝে গ্যাসের ওষুধ সেবন করেন, যা সমস্যাকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করে তোলে। যদি কোনো ব্যক্তি হঠাৎ করে খাবারের পর প্রচণ্ড অস্বস্তি অনুভব করেন, পেটে ব্যথা হয় এবং এর সঙ্গে শ্বাসকষ্ট বা ক্লান্তি থাকে, তাহলে তা হার্টের সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। বিশেষ করে, যদি এই লক্ষণগুলোর সঙ্গে অতিরিক্ত ঘাম, মাথা ঘোরা বা বুকের চাপ অনুভূত হয়, তবে তা অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া উচিত।

পা, গোড়ালি বা পায়ের পাতায় ফোলা

হার্ট যখন ঠিকভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়, তখন শরীরে পানি জমতে শুরু করে, যা পা, গোড়ালি এবং পায়ের পাতায় ফোলা সৃষ্টি করে। এই অবস্থা চিকিৎসাগতভাবে এডিমা (Edema) নামে পরিচিত এবং এটি সাধারণত হার্ট ফেইলিউরের অন্যতম প্রধান লক্ষণ। রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হলে শরীরের নিচের অংশে তরল জমতে থাকে, যার ফলে পা ভারী হয়ে যায়, জুতা শক্ত লাগতে পারে এবং ফোলা জায়গায় চাপ দিলে গর্ত পড়ে যেতে পারে।

প্যানিক অ্যাটাক কী? লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার

এডিমা মূলত তখন ঘটে যখন হার্ট পর্যাপ্ত রক্ত পাম্প করতে পারে না, ফলে শরীরের তরল লসিকাগুলো জমে যায় এবং ফুলে ওঠে। এটি কিডনির কার্যক্ষমতা হ্রাসের কারণেও হতে পারে, যা আবার হার্টের দুর্বলতার সঙ্গে সম্পর্কিত। দীর্ঘ সময় বসে থাকলে বা দাঁড়িয়ে থাকলে এই ফোলাভাব আরও বাড়তে পারে। অনেক সময় এটি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা অন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদি রোগের কারণেও হতে পারে। যদি এই লক্ষণের সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, ক্লান্তি, বা বুক ধড়ফড় করার সমস্যা থাকে, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া

হঠাৎ মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়াকে আমরা অনেক সময় সাধারণ ক্লান্তি বা দুশ্চিন্তার ফল বলে মনে করি। কিন্তু এটি যদি নিয়মিত ঘটে এবং কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া দেখা দেয়, তাহলে তা হার্টের সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। বিশেষ করে যখন হার্ট শরীরে পর্যাপ্ত রক্ত সঞ্চালন করতে ব্যর্থ হয়, তখন মস্তিষ্কে রক্তের ঘাটতি দেখা দেয়, যার ফলে মাথা ঝিমঝিম করা বা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

এই ধরনের সমস্যা সাধারণত হার্ট ব্লক, নিম্ন রক্তচাপ, বা অ্যারিথমিয়া (Arrhythmia) থাকার ফলে হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, এটি হার্টের ভালভের অসুখ বা কার্ডিওমায়োপ্যাথির (Cardiomyopathy) কারণেও হতে পারে। যদি কেউ দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মাথা ঘোরা অনুভব করেন, বা অজ্ঞান হয়ে যান, তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। বিশেষ করে, যদি মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হওয়ার সঙ্গে বুক ধড়ফড় করা, শ্বাসকষ্ট, বা বুকে চাপ অনুভূত হয়, তবে তা হার্টের গুরুতর সমস্যার সংকেত হতে পারে।

অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ

দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension) হলো হার্টের জন্য একটি নীরব ঘাতক, যা ধীরে ধীরে হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা হ্রাস করে এবং বিভিন্ন হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। সাধারণত উচ্চ রক্তচাপের নির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ থাকে না, তাই একে “নীরব ঘাতক” বলা হয়। কিন্তু এটি যদি দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে, তবে তা হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং কিডনির সমস্যার কারণ হতে পারে।

উচ্চ রক্তচাপ যখন স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি থাকে, তখন হার্টকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়, যার ফলে হৃদযন্ত্র দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এটি রক্তনালীকে সংকুচিত করে, যার ফলে রক্ত সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হয় এবং হার্টের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়। উচ্চ রক্তচাপের কারণে অনেক সময় মাথাব্যথা, ঝাপসা দেখা, বুক ধড়ফড় করা এবং ক্লান্তি অনুভূত হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ রক্তচাপ থাকলে নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করা এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে এটি হার্টের বড় কোনো ক্ষতি না করতে পারে।

দুর্বল হার্ট চেনার কিছু উপায়

দুর্বল হার্ট চেনার কিছু উপায়

হার্ট আমাদের শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর মধ্যে একটি, যা রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে শরীরের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ করে। কিন্তু যখন হার্ট দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন এটি তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে এবং শরীর বিভিন্ন উপায়ে সংকেত দিতে শুরু করে। দুর্বল হার্টকে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে বড় ধরনের সমস্যা এড়ানো সম্ভব হয়। নিচে দুর্বল হার্ট চেনার পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।

শ্বাসকষ্ট হওয়া

দুর্বল হার্টের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে একটি হলো শ্বাসকষ্ট। হার্ট যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন এটি শরীরে প্রয়োজনীয় রক্ত পাম্প করতে পারে না, ফলে ফুসফুস এবং অন্যান্য অঙ্গগুলো পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না। এর ফলে হাঁটাচলা, সিঁড়ি ভাঙা বা সামান্য পরিশ্রমেই শ্বাসকষ্ট অনুভূত হয়।

শ্বাসকষ্ট সাধারণত দুইভাবে প্রকাশ পায়—

  • সক্রিয়তার সময় শ্বাসকষ্ট: হেঁটে যাওয়ার সময় বা শারীরিক পরিশ্রমের সময় যদি অস্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, তাহলে এটি হার্টের দুর্বলতার ইঙ্গিত হতে পারে।
  • বিশ্রামের সময় শ্বাসকষ্ট: অনেক ক্ষেত্রে, দুর্বল হার্টের কারণে বিশ্রামের সময়ও শ্বাসকষ্ট হতে পারে, বিশেষ করে রাতে শোবার পর এটি বেড়ে যায়। এটি হার্ট ফেইলিউরের অন্যতম প্রধান লক্ষণ, যেখানে শরীরে অতিরিক্ত তরল জমে যায় এবং ফুসফুসে চাপ সৃষ্টি করে।

শ্বাসকষ্ট যদি নিয়মিতভাবে দেখা দেয়, তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা

দুর্বল হার্টের অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব করা। স্বাভাবিক কার্যক্রমের পরও যদি শরীর চরম দুর্বলতা অনুভব করে এবং বিশ্রামের পরও শক্তি ফিরে না আসে, তাহলে এটি হার্টের কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার ইঙ্গিত দিতে পারে।

কেন এটি হয়?

  • হার্ট যখন ঠিকমতো রক্ত পাম্প করতে পারে না, তখন শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর দিকে রক্ত প্রবাহিত হয় এবং পেশি ও হাত-পায়ের রক্তপ্রবাহ কমে যায়। ফলে সহজেই ক্লান্তি বোধ হয়।
  • যেসব মানুষ হার্ট ফেইলিউরে ভুগছেন, তারা সাধারণত সামান্য কাজ করলেই শক্তিহীন হয়ে পড়েন।

যদি সাধারণ কাজের পর অস্বাভাবিক দুর্বলতা অনুভূত হয় এবং এটি নিয়মিত ঘটে, তাহলে হার্টের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করা প্রয়োজন।

হাত, পা, পায়ের পাতায় ফোলা

দুর্বল হার্টের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংকেত হলো শরীরে তরল জমে যাওয়া, বিশেষ করে হাত, পা, পায়ের পাতা ও গোড়ালিতে ফোলা দেখা দেওয়া। যখন হার্ট দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন এটি সঠিকভাবে রক্ত প্রবাহিত করতে পারে না, ফলে শরীরে অতিরিক্ত তরল জমতে থাকে।

কীভাবে চেনা যাবে?

  • পায়ের পাতা ও গোড়ালি ফুলে ওঠে এবং চাপ দিলে গর্তের মতো দাগ পড়ে থাকে।
  • জুতা পরে হাঁটতে অস্বস্তি হয় এবং পা ভারী অনুভূত হয়।
  • হাতের আঙুল ফুলে গেলে আংটি পরা কঠিন হয়ে যায়।

এটি এডিমা (Edema) নামেও পরিচিত এবং এটি হার্ট ফেইলিউরের অন্যতম লক্ষণ হতে পারে।

বুক ধড়ফড় করা বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন

হার্ট যখন দুর্বল হয়ে যায়, তখন এটি স্বাভাবিক ছন্দে ধাক্কা দিতে পারে না, ফলে বুক ধড়ফড় করা বা হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে। এটি অ্যারিথমিয়া (Arrhythmia) নামেও পরিচিত।

কীভাবে বোঝা যাবে?

  • হার্টবিট কখনো খুব দ্রুত চলে (Tachycardia) আবার কখনো খুব ধীর হয়ে যায় (Bradycardia)।
  • হঠাৎ বুক ধড়ফড় করে ওঠে, বিশেষ করে বিশ্রামের সময় বা রাতে ঘুমানোর আগে।
  • সামান্য কাজেই মাথা ঘুরতে পারে এবং ক্লান্তি অনুভূত হতে পারে।

যদি নিয়মিত বুক ধড়ফড় করা বা হৃদস্পন্দন অনিয়মিত মনে হয়, তবে এটি হার্টের দুর্বলতার সংকেত হতে পারে।

মাথা ঘোরা বা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া

হার্টের প্রধান কাজ হলো শরীরের প্রতিটি অংশে পর্যাপ্ত পরিমাণ রক্ত সরবরাহ করা। কিন্তু যখন এটি দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন মস্তিষ্কে যথেষ্ট পরিমাণ রক্ত পৌঁছায় না, ফলে মাথা ঘোরা বা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে।

এটি সাধারণত দুইভাবে দেখা দেয়—

  • হঠাৎ মাথা ঝিমঝিম করা: বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর পর বা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর মাথা হালকা লাগা বা দুলতে থাকা।
  • অজ্ঞান হয়ে যাওয়া: রক্তচাপ দ্রুত কমে গেলে বা হার্টবিট অনিয়মিত হয়ে গেলে হঠাৎ জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা তৈরি হতে পারে।

এটি মারাত্মক হার্টের সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে, তাই নিয়মিত মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

উপসংহার

আমাদের হৃদয়ই আমাদের জীবন, কিন্তু আমরা কতটুকুই বা এর যত্ন নেয়া সম্পর্কে সচেতন? পরিসংখ্যান বলছে, আধুনিক জীবনযাত্রার কারণে তরুণদের মধ্যেও হৃদরোগের হার বাড়ছে উদ্বেগজনকভাবে। তবে সুখবর হলো, সময়মতো লক্ষণগুলো চিহ্নিত করে জীবন রক্ষা করা সম্ভব। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা হার্টের সুস্থতা নিশ্চিত করতে পারি। তাই নিজের শরীরের দেওয়া সতর্ক সংকেতগুলো উপেক্ষা না করে, সচেতন হোন। কেবলমাত্র একটি সুস্থ হৃদয়ই দিতে পারে দীর্ঘ ও প্রাণবন্ত একটি জীবন! ধন্যবাদ এতক্ষণ সাথে থাকার জন্য। এরকম আরো স্বাস্থ্য বিষয়ক টিপস পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।

Related posts

Leave a Comment